মহানবী হজরত মুহাম্মদ সা: মদিনায় গড়ে তুলেছিলেন মানবজাতির ইতিহাসের সর্বোত্তম ও জনকল্যাণমূলক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। এ রাষ্ট্র পরিচালনায় রাসূলুল্লাহর অর্থনৈতিক চিন্তা দর্শনের এবং সমাজ সংস্কারের দিকনির্দেশনা পাওয়া যায়। র্ষ্ট্রা পরিচালনায় মদিনা রাষ্ট্রের প্রশাসন ছিল স্বতন্ত্র ও সুসংহত এক সিস্টেম। এ রাষ্ট্রের প্রশাসনিক কাঠামো রচিত হয় মহানবী সা:-এর প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে। ইসলামী সমাজের প্রকৃতি, কর্মসূচি, ঐতিহ্য ও বৈশিষ্ট্যের ভিত নির্মাণ করেন রাসূলুল্লাহ সা:। এ প্রশাসনের কাঠামো একদিনে গড়ে ওঠেনি। মহানবী সা: পরিচালিত ইসলামী আন্দোলনের বিকাশমান পর্যায়ে প্রশাসনিক কাঠামো সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত কর্মকর্তা সাহাবী রা:-গণ-জনবিচ্ছিন্ন বা দায়িত্বানুভূতিহীন বিশেষ সুবিধাভোগী কোনো গোষ্ঠী ছিলেন না। তাঁরা প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডে দায়িত্বশীলতার এক অত্যুজ্জ্বল নজির স্থাপন করেছিলেন। ফলে মদিনা রাষ্ট্রের প্রশাসনে নাগরিকদের প্রতি তাদের দায়িত্বশীলতার নীতি প্রবর্তিত হয়েছিল। তাঁরা একাধারে দায়ী ছিলেন আল্লাহ নিকট, রাসূলুল্লাহ সা:এর নিকট, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নিকট এবং তাদের নিজেদের বিবেকের প্রতি। এ ধরনের জবাবদিহিতার চর্চা রাষ্ট্রকে সুশৃঙ্খল হতে সাহায্য করে। সম্পদের অপচয়, সম্পদ বিনষ্ট, কাজে ফাঁকিবাজি থেকে রাষ্ট্রের কর্মকর্তারা সূরায় থাকে।
রাসূলুল্লাহ অর্থনৈতিক দর্শন : রাসূলুল্লাহর সা: মদিনা রাষ্ট্রের অর্থনীতি স্বাধীন অর্থনীতি হলেও তা অবাধ ছিল না। কারণ ইসলামী অর্থনীতিতে উৎপাদন, উপার্জন, ব্যয়, ভোগ, সঞ্চয়, বিনিয়োগ ইত্যাদি সব ক্ষেত্রেই ব্যক্তির ওপর নিয়ন্ত্রণারোপ করা হয়েছে। ইসলাম অর্থনীতির ক্ষেত্রে ব্যক্তির নিরঙ্কুশ স্বাধীনতাকে স্বীকার করে না। এ ক্ষেত্রে ব্যক্তির ওপর আইনের নিয়ন্ত্রণ পর্যাপ্ত। ফলে সুবিচার প্রতিষ্ঠার ব্যবস্থা এতে নিশ্চিত।
১. সম্পদ উৎপাদন ও বণ্টন : ইসলাম মানুষকে অর্থোপার্জনে পুরোপুরি স্বাধীনতা দিয়েছে এবং সম্পদ উপার্জনের পথ বাতলে দিয়েছে। রাসূলুল্লাহ সা:-এর মদিনা রাষ্ট্রের অর্থপ্রশাসনের লক্ষ্য ছিল সম্পদের পূর্ণ ব্যবহার। যাবতীয় বস্তুগত ও মানবীয় সম্পদের পূর্ণাঙ্গ ও ভারসাম্য পূর্ণ ব্যবহার মদিনা রাষ্ট্রে নিশ্চিত করা হয়েছিল। মানবকল্যাণের লক্ষ্য হাসিলের জন্যই মহানবী সা: অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সসীম সম্পদের দক্ষতাপূর্ণ বরাদ্দ ও ব্যবহার করেছিলেন। মদিনা রাষ্ট্রের অর্থনীতিতে সম্পদ ও সেবাপ্রাপ্তি এবং ত্যাগ উভয়ের মধ্যেই কল্যাণ নিহিত আছে বলেই মনে করা হতো। সম্পদের ব্যবহার, উৎপাদন ও ভোগ শুধু ইহজাগতিক সুখের জন্য নয়। এর যথাযথ ব্যবহারের মাধ্যমে পরকালীন কল্যাণও নিশ্চিত করতে হবে। বঞ্চিতদের অর্থনৈতিক প্রয়োজন মেটানো ও তাদের মানবিক মর্যাদার যথাযথ প্রতিষ্ঠা করতে হবে। মদিনা রাষ্ট্রে ব্যক্তির সম্পদে সমাজের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। বৈধ পন্থায় উপার্জিত ধন-সম্পদে অন্যদেরও অধিকার রয়েছে। বিশেষত আত্মীয়স্বজন এবং সমাজে যারা মন্দভাগ্য তাদের প্রতি সহযোগিতা ও সহমর্মিতার হাত বাড়িয়ে দেয়া প্রতিটি বিত্তবান নাগরিকের ঈমানি দায়িত্ব। কুরআনের আদর্শ অনুসারে নাগরিকরা নিজেদের প্রয়োজনীয় ব্যয় নির্বাহের পর যাদের হাতে উদ্বৃত্ত অর্থ থাকত তারা দরিদ্র আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশী ও সমাজের বঞ্চিত ভাগ্যাহত লোকদের ন্যূনতম প্রয়োজন পূরণের উদ্দেশ্যে তা বাধ্যতামূলকভাবে ব্যয় করত। সমাজের বিত্তহীন ও অভাবগ্রস্ত নাগরিকদের প্রয়োজন পূরণ ও কল্যাণ সাধনের জন্য দেয় কুরআনের নির্দেশনা রাষ্ট্রের অর্থনীতিতে বাস্তবায়ন করতে হবে। রাসূলুল্লাহ সা:-এর নীতি ছিল যে, ইসলাম গ্রহণকালে যে ব্যক্তি যে সম্পদের মালিক ছিল তা তারই মালিকানায় থাকবে। মালিকানাহীন জমির ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, যে ব্যক্তি তা আবাদ করবে সে-ই তার মালিক। সম্পদ যাতে পূঞ্জীভূত না থাকে সেজন্য মিরাসী আইন রয়েছে। ইসলামী অর্থব্যবস্থায় ব্যক্তি মালিকানার যে অধিকার রয়েছে তা ব্যক্তির নিজ জীবন পর্যন্ত সীমাবদ্ধ নয়, বরং তা উত্তরাধিকার সূত্রে বংশানুক্রমে অনন্তকাল চলতে থাকবে।
২. সুদমুক্ত অর্থব্যবস্থা : সুদমুক্ত অর্থব্যবস্থাই সমাজকে পরিশুদ্ধ করে। আমরা জানি ‘আল্লাহ ব্যবসাকে হালাল করেছেন আর সুদকে করেছেন হারাম। সুদ অর্থের আবর্তন ও ঘূর্ণায়মানকে বন্ধ করে দেয়। ফলে গণমানুষের হাত থেকে অর্থ গুটিকয়েক মানুষের হাতে গিয়ে পূঞ্জীভূত হয়। শিল্পকারখানা প্রতিষ্ঠার পথ রুদ্ধ হয়ে পড়ে। বেকারত্ব বৃদ্ধি পায়। সমাজে নানা অপরাধ ছড়িয়ে পড়ে। বিনিয়োগ প্রবাহ কমে যায়। সেজন্য সুদমুক্ত অর্থনীতি প্রতিষ্ঠার জন্য রাসূলুল্লাহ ভূমিকা ছিল অত্যন্ত জোরালো। সহিহ মুসলিম হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সা: সুদদাতা, সুদ গ্রহীতা, সুদের লেখক এবং সুদি লেনদেনের সাক্ষীদ্বয়ের প্রতি লানত করেছেন। তিনি বলেছেন, তারা সবাই সমান অপরাধী। বিদায় হজের ভাষণে তিনি বলেছেন, জাহেলী যুগের সব সুদও বাতিল করা হলো। সর্বপ্রথম আমি নিজ খান্দানের সুদ-আব্বাস বিন আব্দুল মুত্তালিবের সুদ বাতিল করে দিলাম। এভাবে তিনি সুদি ব্যবস্থা বন্ধ করে দিয়ে অর্থের আবহ চালু করে দেন। কায়েম হলো সুদমুক্ত অর্থনীতি। কায়েম হলা দরদী সমাজ।
৩. ব্যবসা সম্প্রসারণ ও প্র্যাকটিকেল ব্যাংকার : রাসূলুল্লাহ সা: একজন সফল ব্যবসায়ী ছিলেন। পাশাপাশি একজন বাস্তব ব্যাংকারও ছিলেন। ইসলামী ব্যাংকগুলো কিভাবে ব্যবসা করবে তা নিজেই করেছেন ও দেখিয়ে দিয়েছেন। তিনি মুদারাবা বিনিয়োগের আওতায় হজরত খাদিজা রা:-এর সাথে ব্যবসা করেছেন। এ ব্যবসায় একপক্ষের থাকবে পুঁজি যাকে সাহিবুল মাল বা পুঁজি বিনিয়োগকারী বলে অপর পক্ষ তার বিশ্বস্ততা, মেধা, সময় ও শ্রম দান করে ব্যবসা পরিচালনা করবে যাকে মুদারিব বলে। রাসূলুল্লাহ সা: তার বিশ্বস্ততা, সততা, মেধা ও সময় দান করে ব্যবসা পরিচালনা করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘বিশ্বস্ত, সত্যাশ্রয়ী ব্যবসায়ী কিয়ামতের দিন শহীদদের সাথে অবস্থান করবে।’ রাসূলুল্লাহ সা: ব্যবসা বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সব প্রকার অন্যায় আচরণ দূর করেছিলেন। তিনি মজুদদারির মাধ্যমে কৃত্রিম সঙ্কট, প্রতারণা, মিথ্যা আশ্বাস, চোরাই ব্যবসা করা, ওজনে কমবেশি করা, পণ্যে ভেজাল মেশানো ইত্যাদি দূর করেন ও এ ধরনের অন্যায় কাজ থেকে সবাইকে দূরে থাকতে বলেন।
৪. জাকাতভিত্তিক অর্থব্যবস্থা : সম্পদ যাতে শুধু ধনীদের মাঝে আবর্তিত না হয়, সেজন্য জাকাতভিত্তিক অর্থনীতি প্রতিষ্ঠা করা হয়। পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থা ধ্বংস করে একটি ন্যায়ভিত্তিক অর্থব্যবস্থা কায়েমের জন্য জাকাত বড় হাতিয়ার। ইসলামী অর্থনীতিতে এটি ধনীদের ওপর ফরজ হলেও ভারসাম্য সমাজ ও কল্যাণমূলক সমাজব্যবস্থার উপকরণ। আল কুরআন হচ্ছে এমন এক ঐশী গ্রন্থ যেখানে রাষ্ট্রীয় রাজস্ব তথা সরকারি আয়ের খাতসমূহ এবং রাষ্ট্রীয় ব্যয়ের খাত সম্পর্কে স্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। মুষ্টিমেয় কিছু লোকের হাতে সম্পদ কুক্ষিগত করাকে ইসলাম নিষিদ্ধ করেছে। সম্পদ ওপর থেকে নিচের দিকে প্রবাহিত করার জন্য বিভিন্ন মেকানিজমের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। এর মাধ্যমে সম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিত হয়, বৈষম্য কমে, সামাজিক বৈষম্য নির্মূল হয় এবং শ্রেণী সঙ্ঘাতের অবসান ঘটে। ইসলামী অর্থনীতিতে উৎপাদন ও আয়ের মধ্যে ইসলামী মূল্যবোধ সম্পৃক্ত থাকে। জীবনের ক্ষতি করে এমন পণ্য উৎপাদন ও আয় হারাম করা হয়েছে। একদিকে ইসরাফ ও তাবজির সম্পর্কে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করা হয়েছে, অন্যদিকে ইহতিকার বা মজুদদারি সম্পর্কে শাস্তিমূলক ব্যবস্থার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ইসলামী অর্থনীতিতে সুস্পষ্টভাবে ব্যক্ত হয়েছে আয় ও উৎপাদনের পথ ও প্রক্রিয়া হবে হালাল, হারাম পথ চিরদিনের জন্য বন্ধ। ইসলামী অর্থনীতিতে অমুসলিমদের ওপর করারোপ বস্তুত তাদের প্রতি কর্তব্যবোধেরই পরিচায়ক। মুসলিম নাগরিকদের মতো অমুসলিমদেরও জান ও মালের হিফাজত রাষ্ট্রের কর্তব্য। সর্বকালের সফল অর্থনীতিবিদ ছিলেন মহানবী হজরত মুহাম্মদ সা:। এ মহামানবের অর্থনৈতিক আদর্শ ছাড়া মানুষের মুক্তি, বৈষম্যহীন সমাজ ব্যবস্থা প্রবর্তন করা সম্ভব নয়। মানবরচিত কোনো মতবাদ এ সমাজকে সুষম ও ন্যায়ভিত্তিক রূপ দিতে পারবে না। কুরআন সুন্নাহ অনুযায়ী অর্থনীতি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই বৈষম্যহীন, কল্যাণমূলক ও সুখী সমাজ প্রতিষ্ঠা সম্ভব।
লেখক : অর্থনীতি বিশ্লেষক